কাবুল দখলের পর থেকেই তালেবান একের পর এক চীনের প্রতি শুভেচ্ছাবার্তা পাঠাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারে, এমন কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তালেবান। বেইজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নামে পরিচিত আন্তদেশীয় যোগাযোগ প্রকল্পের প্রতি সমর্থন দিয়েছে, এমনকি তারা চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপিইসি) প্রকল্পে অংশগ্রহণ করতে চায় বলেও জানিয়েছে।

তালেবান সরকারের এসব প্রতিক্রিয়ায় চীন সন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং তারা তালেবানকে সর্বোচ্চ সহায়তা দেওয়ার কথাও বলেছে। কিন্তু আফগানিস্তানে ভবিষ্যতে চীনের যেসব খাতে বড় বড় প্রকল্প পরিচালনার সুযোগ আছে, তা নিয়ে কোনো পক্ষই মুখ খুলছে না। তালেবানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় কাজ করেছে। প্রথমত, তালেবান দ্রুততার সঙ্গে নির্বিঘ্ন বিজয় অর্জন করেছে এবং পানশির উপত্যকাও মসৃণভাবে কবজা করেছে। দ্বিতীয়ত, তালেবান তার অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে থাকবে বলে কথা দিয়েছে এবং বাইরের কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে, বিশেষত চীনের উইঘুরদের নিয়ে তারা মাথা ঘামাবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অন্য সদস্যদেশগুলো তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে। বেইজিং একা তালেবানকে সমর্থন দেয়নি। তুরস্ক, রাশিয়া, ইরান ও কাতার ইতিমধ্যে তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। সেটি বেইজিংকে তালেবান সরকারের সঙ্গে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

তালেবানের আগেরবারের শাসনকে বেইজিং বিরোধিতা করলেও এবার ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। তালেবান কাবুল দখলের পর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা মনে করে, আফগানিস্তান পরিস্থিতি মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তার মানে, চীন তালেবানের এ বিজয়কে তর্কাতীত, সেই সঙ্গে অলঙ্ঘেয়ও মনে করছে। মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ ও গন্তব্য আফগান জনগণের হাতে ফিরে এসেছে। অর্থাৎ, চীন তালেবানকে আফগান জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধি বলে মনে করছে।

তালেবানকে এভাবে চীনের স্বাগত জানানোর কারণ, তালেবানের হাতে যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরাট পরাজয় হয়েছে, সেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের তুমুল উত্তেজনা চলছে। চীনের দৃষ্টিতে তালেবানের এ জয় আমেরিকান সামরিক হস্তক্ষেপ এবং পশ্চিমাদের গণতন্ত্র চাপিয়ে দেওয়ার নিরীক্ষার ওপর এক বড় আঘাত। আফগানিস্তানে তালেবানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে উদার ও ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে উঠবে বলে আশা করা হয়েছে। তালেবান তাদের সরকার ঘোষণা করার পরই বেইজিং আফগানিস্তানকে কোভিডের টিকা এবং ৩ কোটি ১০ লাখ ডলার সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আফগানিস্তানের এ নতুন পরিস্থিতি সেখানে চীনকে আরও সংহত অবস্থান এনে দিয়েছে।

তালেবানের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানের ওপর বেইজিংয়ের তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশ রাশিয়া, ইরান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানের সঙ্গে তালেবান ইস্যুতে চীন সুর মিলিয়েছে। কাবুলে পশ্চিমা দূতাবাসগুলো বন্ধ হয়ে থাকায় চীন অনেকটাই নিশ্চিন্ত হয়েছে। এর সঙ্গে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক সুযোগগুলোর বিষয়ে চীনের আগ্রহও বাড়তে শুরু করেছে। আফগানিস্তানে বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ রয়েছে। এ সম্পদের দিকেই চীনের মূল আগ্রহ। কাবুলের নিকটবর্তী মেস আয়নাক তামার খনি, উত্তরাঞ্চলীয় আমু দারিয়া এলাকার তেল উৎপাদন প্রকল্পসহ বেশ কয়েক জায়গায় চীন কিছু বিনিয়োগ করে ফেলেছে। কিন্তু সেসবের চেয়েও চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তার বিআরআই প্রকল্প নির্বিঘ্ন করা।

এ ছাড়া আফগানিস্তানকে সিপিইসির আরেকটি শাখা বানানোর জন্য চীন পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা করছে। যদি আলোচনা সফল হয় ও আফগানিস্তান যদি সিপিইসির সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহলে আঞ্চলিক বাণিজ্য যোগাযোগ বাড়বে এবং চীন ও আফগানিস্তান উভয় দেশ উপকৃত হবে। চীন ভালো করে জানে, আফগানিস্তানে তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে গেলে সেখানকার পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতেই হবে। এ কারণে তারা ওয়াশিংটনকে তালেবানের সঙ্গে থাকতে বলছে এবং ইতিবাচকভাবে তালেবান সরকারকে পরিচালিত হতে সহায়তা করতে বলছে। যুক্তরাষ্ট্রকে তারা তালেবান সরকারকে অর্থসহায়তা দিতেও বলছে।

চীন মনে করে, ওয়াশিংটনের পরিকল্পনা ছিল, তারা হুট করে সেনা সরিয়ে নেওয়ার পর তালেবান ক্ষমতা নিতে যাবে এবং তখনই আফগানিস্তানে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, যা চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকাকেও অস্থির করে তুলবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। চীন এটিও মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের উত্থানকেই চীনে অস্থিরতা সৃষ্টির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবে। এ কারণে আফগানিস্তানে চীনের সতর্ক উপস্থিতি জারি থাকবে।

ইয়ুন সান : ওয়াশিংটন ডিসির স্টিমসন সেন্টারের চায়না প্রোগ্রামের পরিচালক। তার এই লেখাটি এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া হয়েছে।